মাকে ছেড়ে এক মুর্হূতের জন্যেও হাসপাতাল থেকে আসেননি সোহাগ। মায়ের সেবা-শ্রুশুষা করার জন্য সার্বক্ষনিক ছিলো মায়ের সঙ্গে। সেই মায়ের বুকে মাথা রেখেই বুধবার (২৫ মে/২০২২) ভোরে চিরদিনের নিদ্রায় ঘুমিয়ে গেলেন যুবলীগ কর্মী সোহাগ। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পৌর শহরের কলাবাগান এলাকার মৃত নওশের আলী ড্রাইভারের একমাত্র পুত্র।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মতিউর রহমান জানান, সোহাল ঘুমের মাঝেই হৃদযন্ত্রের ক্রীয়াবন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন।
হাসপাতালে তার পাশে বেডে থাকা রোকসানা আক্তার জানান, সোহাগ মাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। মায়ের কাপড়-চোপড় থেকে ধরে সব কাজ করেছে এই ছেলেটি। মাকে সেতো মেয়ের মতো আগলে রেখেছিলো। ইস্, ও কী! ভদ্র ছেলে। কথাগুলো বলতে গিয়ে তিনিও হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
মাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সোহাগের মৃত্যুর বিষয়টি হাজারো নেটিজেন তাদের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। মাকে ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রশংসায় পঞ্চমুখ নেটিজেনরা। তাদেরই একজন আতিক। তিনি বলেন, ‘সোহাগ ভাই মায়ের বুকেই ঘুমিয়ে থাকবেন-এটাই তার বেহেশত।’
সোহাগের লাশ যখন বাড়িতে আসে তখন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সোহাগের স্ত্রী সাবিনা আক্তারের কোলে থাকা দু’বছরের কন্যা শারদা মনি, বারবার তার মাকে বলতে থাকে; ‘মা, মা, এইতো বাবা আসছে’, কোমলমতি শিশুর এ আবেগঘন অবুঝ বক্তব্যে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
সোহাগের মা রোকেয়া বেগমের কোমড়ে ব্যাথা ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যার থাকায় গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। সেই থেকে মায়ের সঙ্গেই ছিলো সোহাগ। শুধু মায়ের নয়; গৌরীপুর থেকে হাসপাতালে যাওয়া প্রত্যেকটি রোগীর প্রতিদিন খোঁজখবর ও সহযোগিতাও করে আসছিলো। স্বার্থহীনভাবে দলের জন্য নিবেদিত এক যুবলীগ কর্মী ছিলো। নিজের বাসার বিদ্যুৎ লাইনটি বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া টাকার জন্য বিচ্ছিন্ন করা হলেও কাউকে বলেননি। যুবলীগের তুখুড় কর্মী ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খানের সেনাপতিখ্যাত এ কর্মীর বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নের ঘটনায় বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো কর্মীকে দমকও দেয়নি। অথচ সোহাগের চেয়েও ১০গুণ বেশি বকেয়া থাকার পরেও তাদের লাইন বিচ্ছিন্ন করার সাহস পায়না এ বিভাগ! স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেই অন্ধকারে থেকেও হাসিমুখে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সারাজীবন শুধু অন্যের সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজেছেন, নিজের জন্য কিছুই করতে পারেননি এ কর্মী।
শোকে ভারক্রান্ত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খান। তিনি বলেন, সোহাগ বৃহস্পতিবার তার মাকে নিয়ে ময়মনসিংহ হাসপাতালে যান। মায়ের চিকিৎসার জন্য সে হাসপাতালেই ছিলো। আমিও গতকাল দেখতে গিয়েছিলাম। তখন সোহাগ গৌরীপুরের আরো ৪/৫জন রোগীর কাছে নিয়ে যায়। আমি তাদেরও ভালো-মন্দ খোঁজখবর নিয়ে বাড়ি আসি। মহিলা ওয়ার্ডে রাতে পুরুষ থাকতে পারে না। তারপরেও সে মাকে ছেড়ে বাহিরে যেতে চাইনি। মধ্যরাতে মায়ের পাশেই এসে ঘুমায়। রাত আড়টার দিকে সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়।
দুপুরে কলাবাগানে তার জানাযা নামাজ শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন হয়। জানানাত্তোর স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন গৌরীপুর পৌরসভার কাউন্সলর মো. সাদেকুর রহমান। স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ এমপি, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খান, ইউএনও হাসান মারুফ, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মতিউর রহমান, অচিন্তপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হাই, মাওহা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল ফারুক, বোকাইনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল মোক্তাদির শাহীন, পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মো. আব্দুল কাদির প্রমুখ